ডা.মুহাম্মাদ  মাহতাব হোসাইন মাজেদঃ আওদ শব্দ থেকে ঈদের উৎপত্তি। ঈদ অর্থ আনন্দ, খুশি, ফুর্তি, আমোদ, উৎসব ইত্যাদি। ফিতর অর্থ রোজা ভঙ্গ করা, স্বভাবজাত বা স্বাভাবিক। ঈদুল ফিতর অর্থ কঠোর সিয়াম সাধনার মুদ্দৎ উতরিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবার খুশি।
ঈদুল ফিতরের দিন গরিব-মিসকিন ও অভাবী লোকদের মধ্যে শরিয়তের নির্ধারিত যে অর্থ বা খাদ্যবস্তু বিতরণ করা হয় তাকে বলে সদকাতুল ফিতর। সদকাতুল ফিতর আদায় করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর ওয়াজিব।
সদাকাতুল ফিতরকে রোজার কাফফা বলা হয়। পক্ষান্তরে ঈদের দিনে অভাবী ব্যক্তিরাও যাতে অনাহারে থাকার কারণে ঈদের খুশি থেকে একেবারে বঞ্চিত না হয় তার জন্যই এ ব্যবস্থা।
ঈদ মুসলিম জাতির একটি বার্ষিক সম্মেলন ও উৎসবের দিন। বিশ্বের প্রত্যেকটি জাতিরই আনন্দ-উৎসবের জন্য বছরে কিছু দিনক্ষণ নির্ধারিত থাকে। তেমনি মুসলমানদের আনন্দোৎসবের জন্য বছরে দু’টি দিন নির্ধারিত রয়েছে। একটি হলো ঈদুল ফিতর ও আরেকটি ঈদুল আজহার দিন। রমজানের সিয়াম সাধনার পরে যে ঈদ তার নাম ঈদুল ফিতর। আর জিলহজ মাসে হজ উপলক্ষে যে ঈদউৎসব পালন করা হয় তাকে বলে ঈদুল আজহা।
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব : এ ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। যারা ঈদের নামাজ আদায় করে না তারা অবশ্যই গুনাহগার হবে।
ঈদ আসে বিশ্ব মুসলিমের দ্বারপ্রান্তে বার্ষিক আনন্দের মহাবার্তা নিয়ে, আসে সীমাহীন প্রেম-প্রীতি বিলাবার সুযোগ নিয়ে, বিগত দিনের সকল ব্যথা বেদনা ভুলিয়ে দিতে, কল্যাণ ও শান্তির সওগাত নিয়ে।
বছরে দু’দিন ঈদের নামাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য যে মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ইসলামী সমাজ কায়েমের প্রেরণা। সমাজকে কলুষ কালিমা মুক্ত করার জজবা, মানবতা ও মনুষ্যত্ব বিকাশের এক বিশেষ অনুশীলন।
ঈদুল ফিতরের ফজিলত : ঈদুল ফিতরের দিনের বহুত ফজিলত রয়েছে। যারা ঈদের দিন যথারীতি ঈদগাহে গিয়ে যথানিয়মে ঈদের নামাজ আদায় করে মহান আল্লাহ তাদের দুআ কবুল করেন এবং তাদের অফুরন্ত পুরস্কার দানে ধন্য করেন। হাদিসে এসেছে, যারা ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ঈদের ময়দানে একত্র হয়, আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের ডেকে জিজ্ঞেস করেন যারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে আজ এখানে সমবেত হয়েছে তাদের কী প্রতিদান দেয়া উচিত? ফেরেশতারা বলেন, পুণ্যময় কাজের পুরোপুরি পারিশ্রমিক দেয়াই উচিত। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইজ্জতের শপথ করে বলেন, অবশ্যই তিনি তারে প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা ঈদের নামাজ সমাপনকারী তাঁর নেক বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি এবং তোমাদের কৃত অতীত পাপকে সওয়াবে পরিণত করে দিলাম’ এ পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নামাজ সমাপনকারীগণ ঈদের মাঠ থেকে এমন অবস্থায় স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলো যেন নিষ্পাপ শিশু।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি পুনণ্য লাভের আশায় দু’ ঈদের রাত জেগে ইবাদত করে সেদিন (কিয়ামতের দিন) তার অন্তর এতটুকু ভীত-সন্ত্রস্ত হবে না যেদিন অন্যদের অন্তর ভীত-বিহ্বল অবস্থায় মৃতবৎ হয়ে পড়বে।
মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রোযাদারদের জন্য বিশেষ একটি পুরুস্কার হচ্ছে, ‘ঈদুল ফিতর’ । আর ঈদের তাৎপর্য অপরিসীম । মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. হাদিসে ইরশাদ করেন , ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন আসে তখন আল্লাহ তা’আলা রোযাদাদের পক্ষে গর্ব করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ তোমরাই বলো রোযাদারেদের রোযার বিনিময়ে আজকের এই দিন কি প্রতিদান দেয়া যেতে পারে ? সেই সমস্ত রোযাদার যারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরী আদায় করেছে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, তে দয়াময় আল্লাহ উপযুক্ত উত্তম প্রতিদান তাদের দান করুন । কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক তাদেরকে দান করুন ।
তখন আল্লাহ তা’আলা রোযাদারদেরকে বলতে থাকেন, ‘হে আমার বান্দা তোমরা যারা যথাযথভাবে রোযা পালন করেছ, তারাবীহর নামাজ পড়েছ, তোমরা তাড়াতাড়ি ঈদগাহে মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাও এবং তোমরা তোমাতের প্রতিদান গ্রহণ করো । ঈদের নমাজের শেষে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সকল পাপগুলোকে পূর্ণের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম । অতএব তোমরা নিস্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও’। বাইহাকী ও মিশকাত শরীফ ।
মহানবী সা. ইরশাদ করেন, ‘ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমযানের রোযা তারাবিহর নামাজসহ আল্লাহ তা’আলার যাবতীয় বিধি-বিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে ।  আর যারা রমযানের রোযা ও তারাবীহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য। বুখারী শরীফ
মহানবী সা. হাদিসে আরো ইরশাদ করেন যে, ‘যারা রমযানে রোযা রাখেনি তারা ঈদের নামাজে সুসংবাদ প্রাপ্ত তথা মুক্তি প্রাপ্ত মানুষের কাতারে শামিল হবে না । তাদের জন্য কোন আনন্দ নেই ।
আর যারা রোযা পালন করেছে, গরীবদেরকে নিজের মাল থেকে ফিতরা দিয়েছে শুধুমাত্র ঈদ তাদের জন্যই । তবে যাদের রোযা রাখার বয়স হয়নি অথবা বিশেষ কোন কারণে রোযা রাখতে পারেনি তারাও ঈদের এই আনন্দে শরীক হতে পারবে । কিন্তু যারা বিনা কারণে এবং অলসতা করে রোযা রাখেনি তাদের জন্য এ ঈদে আনন্দ নেই । এ ঈদ তাদের জন্য আনন্দ স্বরূপ নয়, বরং তিরস্কার স্বরূপ ।
মহানবী সা. আরো ইরশাদ করেন যে, ‘যে ব্যক্তি দু’ঈদের রাতে পুণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগী করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরুস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সেদিনও মরবে না’। আততারগীব
রাসূল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পুণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে সেই ব্যক্তির জন্য সু-সংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’ এবং পুণ্যময় ৫টি রাত হলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, লাইলাতুলকদর,  জ্বিলহজ্জের রাত, আরাফাতের রাত । [বাইহাকী ] এছাড়াও ঈদের অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে ।
লেখক, এম এ কামিল, হাদিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা।
কো-চেয়ারম্যান, হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।